জাতপাতের বন্ধনে বন্দি দেবী দুর্গা, হরিজন সম্প্রদায়ের হওয়ায় সব কিছুতেই ব্রাত্য তারা। সমাজের আর পাঁচটা সার্বজনীন পুজোর মতো এই পুজো নয় !
যে পুজোর কাহিনী শুনলে আপনিও শিউরে উঠবেন। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, একবিংশ শতাব্দীর মাঝে দাঁড়িয়ে এখনো পূজিত হয়। দশ পরিবারের দশভূজা।
দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে চলে আসা মালদার রতুয়া- রতনপুর হাট হরিজন' পাড়ার বড় কর্তা রাধিকা হরিজন এই পুজার প্রচলন ঘটিয়েছিল।
পঞ্চাশ বছর আগের কথা। ওই এলাকার হরিজন সম্প্রদায়ের মোড়লকে মা স্বপ্নাদেশ দেন, মাতৃশক্তির আরাধনা করতে। আর সেই থেকেই কালের নিয়মানুসারে আজও সেই জনাকয়েক হরিজন পরিবারের মধ্যে পূজিত হয়ে আসছেন দেবীদুর্গা।
তাদের মূল জীবিকা, নিজ হাতে বোনা বেতের ঝুড়ি ও ডালি হাটে বাজারে বিক্রি করা। আর তাতেই চলে সংসার। তার মধ্যে দুর্গা দেবীর পুজোয় খামতি রাখেনা তারা। সঙ্কটজনক মুহূর্ত হোক বা মহামারী। মন্দার কালেও দাঁতে দাঁত চেপে পেটে গামছা বেঁধে পূজোর খরচ বহন করে হরিজন সম্প্রদায়রাই।
জেলায় এবং রাজ্যে যখন পুজো মন্ডপ নিয়ে প্রতিযোগিতা। সেই বতর্মানকালে দাঁড়িয়ে তারা টিনের ছাউনিতে দেবীদুর্গার আরাধনা করে নজর কেড়েছেন এলাকায়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল, জাতপাতের ভিত্তিতে হরিজনদের এই পুজোর বরাত গ্রহন করে না স্থানীয় ঢাকি থেকে শুরু করে পুরোহিতরা। উদ্যোক্তাদের কথায় জানা গেল, ওই সম্প্রদায়ের এক মোড়ল রাধিকা হরিজন এই পুজোর প্রচলন করেন।
দুর্গা দেবীর প্রতিমা তৈরির কারিগর থেকে পুজো করার ব্রাহ্মণ পাননি তিনি। অগত্যা তিনি নিজেই দুর্গা প্রতিমা তৈরি করে নিজেই পুরোহিত হিসেবে পুজো শুরু করেন। তাঁর মৃত্যুতে দিশেহারা হয়ে যায় উদ্যোক্তারা। এলাকায় পুরোহিত না পেয়ে প্রতিবেশি বিহার রাজ্য থেকে যৎসামান্য দক্ষিণা দিয়ে পুরোহিত মশাইকে নিয়ে আসেন হরিজনরা।
ষষ্ঠী থেকে দশমী এলাকায় অনেক মন্ডপে ভিড় জমালেও তাদের দেবী দর্শনে আসেন না এলাকার দর্শনার্থীরা। সব কিছুতে ব্রাত্য থাকলেও দেবীর স্বপ্নাদেশের কথা রেখে চলেছেন হরিজন সম্প্রদায়রা। এই দুর্মূল্যের বাজারে নিজের জমানো অর্থ দিয়ে মায়ের পুজো করা তাদের মধ্যে আকাশ ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা। তবুও নিজেদের পেশাকে হাতিয়ার করে পূজোর খরচ তুলেন হরিজন সম্প্রদায়ের মানুষেরা।
রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে একাধিক পূজো কমিটিগুলোকে আর্থিক অনুদান দেওয়া হলেও, ব্রাত্য হরিজনরা। বহুবার আবেদন করলেও আজও সেই আর্থিক অনুদান অধরা। করোনাকার সঙ্কটকাল মুহূর্তে ভাঁটা পড়েছে তাদের পেশায়। তারপরেও থমকে যাননি তারা।সরকারের আর্থিক অনুদান না মিললেও নিজেরাই স্বাবলম্বী তারা।
প্রয়াত রাধিকা হরিজনের পুত্র বধূ বিভা হরিজন জানান, শ্বশুর মশাইয়ের প্রচলিত এই পুজোর রেশ আজও আমরা আঁকড়ে ধরে রেখেছি। আমরা নীচু জাতি। তাই আমাদের পুজোয় শামিল হয়না সমাজের আর পাঁচটা পরিবার। নিজেদের সঞ্চিত অর্থে এই পুজো পরিচালনা করে আসছি।লকডাউনের পরে আমাদের সেইরকম বেতের সামগ্রীর বিক্রি নেই। সরকার আমাদের দিকে নজর দিলে হয়তো মায়ের পুজা সাড়ম্বরে করতে পারব। তবে আমরা কেন ব্রাত্য?
হাতে মাত্র আর দশটা দিন। হরিজনদের পুজো নিয়ে শুরু হয়েছে তোড়জোড়। ইতিমধ্যে কাঠামোতে মাটি পড়েছে। রোদ ঝলমলে শরতের আকাশ।অবশেষে উমা আসবেন বাপের বাড়ি। সঙ্গে কার্তিক, সরস্বতী, লক্ষ্ণী গণপতি ও তাদের বাহনেরা। আর এই পুজোকে ঘিরে পুজোর আনন্দে সামিল হতে চলেছে হরিজনরাও।